about img

অপরাজিতা সম্পর্কে

নারী উন্নয়নের বিভিন্ন সূচকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে নারীর প্রবিশোধিকার এবং অর্থনৈতিক কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণ ও অবদানের মাত্রা ক্রমসম্প্রসারণশীল। প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও জলবায়ু পরিবর্তন জনিত ঝুঁকি হ্রাস ও সক্ষমতা বৃদ্ধি কর্মকান্ডে নারীর অংশগ্রহণও খুবই আশাপ্রদ। এত ইতিবাচক অর্জন সত্তে¡ও এবং জাতীয় পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক উপস্থিতি অনেক দেশের তুলনায় অগ্রগামী হলেও সামগ্রিক বিবেচনায় রাজনৈতিক কর্মকান্ড, বিভিন্ন পর্যায় ও স্তরের রাজনৈতিক কাঠামোতে নারীর অংশগ্রহণ লক্ষণীয় ভাবে কম। 

সাংবিধানিকভাবে নারী পুরুষ নির্বিশেষে বাংলাদেশের সকল নাগরিক নির্বাচন করার এবং নির্বাচিত হবার অধিকারী। তত্বগত এবং আইন দৃষ্টিকোণ থেকে এটি সঠিক হলেও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণ এখানো কাংখিত মাত্রায় তুলনায় অনেক কম। উপরোক্ত বাস্তব এবং সামজিক-সাংস্কৃতিক ও কাঠামোগত কারণে স্থানীয় ও অন্যান্য পর্যায়ে নারীর রাজনৈতিক অংশগ্রহণ এখানো পিছিয়ে রয়েছে।

এ সকল দুর্বলতা কাটিয়ে রাজনৈতিক ক্ষেত্রে নারীর ক্ষমতায়ন তথা রাজনৈতিক কর্ম প্রক্রিয়ায় নারীর অংশগ্রহণের মাত্রা ও কার্যকারিতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে ‘অপরাজিতা : নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন’ ইতোপূর্বে দুই পর্বে (২০১১-২০১৫ ও ২০১৫-২০১৭) বাস্তবায়িত হয়েছে। তারই ধারাবাহিকতায় নতুন ভাবে কর্মসূচী প্রণয়ন করা হয়েছে যার মাধ্যমে হেলভেটাস সুইস ইন্টারকোঅপারেশন (Helvetas Swiss Intercooperation) বাংলাদেশ-এর সমন্বয়ে সহযোগিতা সংস্থা খান ফাউন্ডেশন, ডেমক্রেসিওয়াচ (Democracywatch), প্রিপ ট্রাস্ট(PRIP Trust) ও রূপান্তরের(Rupantar) মাধ্যমে নির্বাচিত ১৬টি জেলা, ৬২টি উপজেলার ৫৪0 টি ইউনিয়নে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হচ্ছে।

অপরাজিতা প্রকল্পের প্রাথমিক স্টেক হোল্ডার হলো প্রথমত ইউনিয়ন পরিষদে নির্বাচিত নারী প্রতিনিধি; দ্বিতীয়তা সম্ভাব্য নারী প্রার্থী যারা ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দীতা করেছেন; তৃতীয়ত নারী যারা ইতিমধ্যেই নেতৃত্ব দিচ্ছেন এবং চতুর্থত ১৬ থেকে ৩৫ বছর বয়সী তরুণী যারা সামাজিক উন্নয়ন কর্মকান্ডে অংশ নিচ্ছেন এবং যারা ভবিষ্যৎ নেতা।

অপরাজিতা প্রকল্প এসডিবি ৫ (জেন্ডার সমতা অর্জন এবং সকল নারী ও মেয়েদের ক্ষমতায়ন) লক্ষ্য রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং জনজীবনে সিদ্ধান্ত গ্রহণের সকল স্তরে নারীদের পূর্ণ এবং কার্যকর অংশগ্রহণ এবং নেতৃত্বের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করা। এবং ১৬ (শান্তি, ন্যায় বিচার ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান) লক্ষ্য টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তভর্‚ক্তিমূরক সমাজের প্রচার, সকলের জন্য ন্যাায় বিচার সুযোগ প্রদান এবং সকল স্তরে কার্যকর, জবাবদিহিমূলক এবং অন্তভর্‚ক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এই লক্ষ্যগুলি অর্জনের সাথে দৃঢ়ভাবে যুক্ত, নারীর বিরুদ্ধে সকল প্রকার বৈষম্য দূর করার বিষয়ে জাতিসংঘের কনভেনশন (ঈঊউঅড), বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় উন্নয়ন নীতিমালা এবং সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এর সাথে একত্রিত হচ্ছে।

প্রকল্পের লক্ষ্য- উদ্দেশ্য

এই প্রকল্পের সামগ্রিক উদ্দেশ্য হলো নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন এবং সরকারের বিশেষ করে স্থানীয় সরকারের বিভিন্ন কাঠামোতে তাদের অংশগ্রহণের মাত্রা বিস্তৃতকরণ এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধি করা।

অপরাজিতার প্রত্যাশিত ফলাফলসমূহ

  • নির্বাচিতজেলাগুলিতে সম্ভাব্য ও নির্বাচিত নারী প্রতিনিধিরা কার্যকরভাবে স্থানীয় সরকারী প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় শাসন ব্যবস্থায় অংশগ্রহন করবে।
  • নির্বচিত জেলাগুলিতে গন্যমান্য ব্যাক্তি, পুরুষ ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলো স্থানীয় রাজিৈতক জীবনে নারীকে কার্যকর অন্তর্ভুক্ত করতে সহায়তা করবে।
  • নীতিমালা এবং আইনী কাঠামো উন্নত করা ও প্রতিবন্ধকতার দিকে মনোযোগদেওয়ার মাধ্যমে জাতীয় পর্যায়ে উপদানগুলিকে বাধা দেওয়া ও সক্রিয় করার লক্ষ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বৃদ্ধি পাবে।
logo white

মূল কার্যক্রমসমূহ নিম্নরূপ:

লক্ষ্যমাত্রা

প্রত্যক্ষ উপকারভোগী: অপরাজিতা প্রকল্প ৬টি বিভাগের মোট ১৬টি জেলায় নির্বাচিত সর্বমোট ৬২টি উপজেলার সবগুলি ইউনিয়নে বাস্তবায়িত হবে। সে অনুযায়ী প্রকল্পটি মোট ৫৪১টি ইউনিয়নে কাজ করবে। এক্ষেত্রে ইউনিয়ন পরিষদের সংরক্ষিত নারী আসনে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিসহ স্থানীয় পর্যায়ের অন্যান্য বর্তমান/সম্ভাব্য নারী নেত্রী/প্রতিনিধিদের সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রকল্পটি বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবে। 

এ ধরনের নারীদের মধ্যে গড়ে প্রতিটি ইউনিয়ন থেকে ১৫ জনকে নিবিড় প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে, এবং সে হিসেবে এ ধরনের মোট প্রত্যক্ষ উপকারভোগীর সংখ্যা হবে ৮১১৫ জন নারী। অধিকন্তু, অপরাজিতা প্রকল্প স্থানীয় নারী নেত্রীদের পরিবারের সদস্যবর্গ থেকে শুরু করে এলাকাবাসীদের মধ্যে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সংশ্লিষ্ট জনসচেতনতা ও জনসমর্থন বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করবে। এক্ষেত্রে সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে থেকে গড়ে প্রতিটি ইউনিয়নে কমপক্ষে ৩৬ জন (এবং উপজেলা পর্যায়ে গড়ে ১০জন) নারী-পুরুষকে সচেতনতামূলক কার্যক্রমের আওতায় প্রত্যক্ষভাবে আনা হবে, এবং সে অনুযায়ী ৬২ উপজেলায় মোট ৩২৪৬০ জনের বেশি সাধারণ নাগরিককে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন বিষয়ে অধিকতর সচেতন করা হবে।


পরোক্ষ উপকারভোগী:  অধিকতর দক্ষ ও জ্ঞান সম্পন্ন নারীরা যদি স্থানীয় উন্নয়নে ইতিবাচক ভূমিকা রাখতে শুরু করে, তাহলে এলাকাবাসীদের সবাই পরোক্ষভাবে সুফল ভোগ করবে। কাজেই নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের লক্ষ্যে যে ৫৪১ টি ইউনিয়নে অপরাজিতা প্রকল্পটি কাজ করবে, সেখানকার সম্মিলিত জনগোষ্ঠীকে পরোক্ষ উপকারভোগী হিসেবে গণ্য করা যেতে পারে।

সরকারি দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সাথে প্রাসঙ্গিকতা

সাংবিধানিকভাবে নিশ্চিতকৃত নারী-পুরুষের সমানাধিকার তথা ন্যায্য সুযোগসুবিধা লাভের দিকনির্দেশনার আলোকে বাংলাদেশে এ যাবত বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ নীতিমালা, কৌশল ও পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। এগুলোর মধ্যে নীতিগত ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক কালের একটি উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ ছিল ২০১১ সালের জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি, যেটির রূপকল্প হলো “এমন একটি সমাজ বিনির্মাণ যেখানে পুরুষ ও নারী সমান সুযোগ লাভ করবে এবং সমতার ভিত্তিতে সকল মৌলিক অধিকার ভোগ করবে”। উল্লেখ্য, নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১-তে নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়ন সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট কিছু পন্থার কথা বলা হয়েছে যেগুলি নিম্নরূপ:

 

৩২.১ রাজনীতিতে অধিকহারে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণ নিশ্চিত করার জন্যে প্রচার মাধ্যমসহ রাজনৈতিক দলসমূহকে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা গ্রহণে উদ্বুধ করা।

৩২.২ নারীর রাজনৈতিক অধিকার অর্জন ও প্রয়োগ এবং এর সুফল সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

৩২.৩ রাজনৈতিক দলের অভ্যন্তরে পর্যায়ক্রমে ৩৩ শতাংশ নারী প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা।

৩২.৪ নির্বাচনে অধিকহারে নারী প্রার্থী মনোনয়ন দেয়ার জন্য রাজনৈতিক দলগুলোকে অনুপ্রাণিত করা।

৩২.৫ নারীর রাজনৈতিক অধিকার আদায় ও প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ভোটাধিকার প্রয়োগে সচেতন করা এবং তৃণমূল পর্যায় থেকে জাতীয় পর্যায় পর্যন্ত ভোটার প্রশিক্ষ্ণ কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা।

৩২.৬ রাজনীতিতে নারীর সক্রিয় অংশগ্রহণের তাগিদ সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে নারী সংগঠনসহ বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহকে প্রচার অভিযান গ্রহণ করার জন্য উদ্বুদ্ধ করা।

৩২.৭ জাতীয় সংসদে সংরক্ষিত মহিলা আসনের সংখ্যা ৩৩ শতাংশে উন্নীত করা ও বর্ধিত সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচনের উদ্যোগ গ্রহণ করা।

৩২.৮ স্থানীয় সরকার পদ্ধতির সকল পর্যায়ে বর্ধিত সংরক্ষিত আসনে প্রত্যক্ষ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা।

৩২.৯ সিদ্ধান্ত গ্রহণ প্রক্রিয়ার সর্বোচ্চ পর্যায়ে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী নিয়োগ করা।

 

উপরের পন্থাসমূহ পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, প্রায় সবগুলিই অপরাজিতা প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য-কৌশলের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, কাজেই এ কথা নিঃসন্দেহে বলা যায় যে প্রকল্পটি সরাসরি নারী উন্নয়ন নীতির আলোকে প্রণীত হয়েছে।

 

এখানে বিশেষভাবে উল্লেখ্য যে, বিদ্যমান গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) অনুসারে রাজনৈতিক দলসমূহে কেন্দ্রীয় পর্যায় সহ সকল পর্যায়ের কমিটিতে ৩৩% পদ নারীদের জন্য সংরক্ষিত করার লক্ষ্যমাত্রা উল্লেখ করা হয়েছে, যা শুরুতে ২০২০ নাগাদ অর্জনের তাগিদ দেওয়া হয়েছিল। অনুরূপভাবে বর্তমানে স্থানীয় সরকারসমূহে ও সংসদেও নির্দিষ্ট সংখ্যক নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসন রয়েছে। কাজেই সার্বিকভাবে অপরাজিতা প্রকল্পের লক্ষ্য-উদ্দেশ্য ও কর্মপন্থা সরকারের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার সাথে সরাসরি সঙ্গতিপূর্ণ এবং উক্ত পরিকল্পনার কিছু নির্দিষ্ট লক্ষ্য পূরণে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।